গর্ভাবস্থায় রক্তাল্পতা কাকে বলে?
অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা একটি খুবই পরিচিত শারীরিক অবস্থা যা বিশেষত উন্নয়নশীল দেশগুলিতে ঘটছে। গর্ভাবস্থায়, বাড়তে থাকা ভ্রূণের সাথে সাথে মাকেও পর্যাপ্ত পরিমাণে পুষ্টিকর খাদ্য এবং অক্সিজেন সরবরাহ করতে রক্তের উৎপাদন বাড়ানোর প্রয়োজন হয়। অতিরিক্ত রক্ত কণিকা তৈরি করার জন্য বেশি লৌহজাত পদার্থ (যা হিমোগ্লোবিন প্রস্তুতিতে প্রয়োজন) এবং অন্যান্য পোষক পদার্থের প্রয়োজন হয়। কিন্তু, যদি শরীরে প্রয়োজনীয় লৌহপদার্থ এবং অন্যান্য গঠনকারী পদার্থ না থাকে যেগুলির প্রয়োজন রয়েছে, তাহলে অতিরিক্ত এই প্রয়োজনীয়তা পরিপূরণ হবে না, ফলে গর্ভাবস্থার অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা দেখা দেয়। এই অবস্থাটি খুবই সাধারণভাবে ঘটে কিন্তু জটিল অবস্থায় পৌঁছোতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডাব্লিউ এইচ ও) অনুযায়ী গর্ভাবস্থায় এই কম মাত্রার হিমোগ্লোবিন (এইচ বি<11জি/ডি এল) থাকাকে গর্ভাবস্থার রক্তাল্পতা বলে। গর্ভাবস্থায় রক্তাল্পতা অকালীন বা অসময়ে জন্মদান, জন্মের পর শিশুর কম ওজন, মাতৃত্বকালীন মৃত্যু (শিশুর মায়ের মৃত্যু) ঘটাতে পারে।
এর প্রধান লক্ষণ ও উপসর্গগুলি কি কি?
রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়ার সাধারণ উপসর্গগুলি হল:
- অবসাদ।
- ক্লান্তি।
- মাথা ঘোরা (মাথায় ভারহীনতা অনুভব করা)।
- মনোযোগে ব্যাঘাত।
- ফ্যাকাসে ঠোঁট, জিভ, ত্বক, এবং নখ (বিবর্ণতা)।
- ঠান্ডা হাত ও পা।
- শ্বাসকষ্ট।
- ট্যাকিকারডিয়া (বর্ধিত গতি>100টি স্পন্দন প্রতি মিনিটে)।
এর প্রধান কারণগুলি কি কি?
গর্ভাবস্থায় রক্তাল্পতার সাধারণ কারণগুলি হল লৌহযুক্ত খাবার পরিমাণমত গ্রহণ না করা, গর্ভাবস্থার পূর্বে ঋতুস্রাব চলাকালীন বেশী রক্তপাত হওয়া, আলসার বা রক্তদান করার পরবর্তী সময়ে, যার ফলে লোহিত রক্ত কণিকার হার উৎপাদনের হারের তুলনায় দ্রুত কমতে থাকে। রক্তাল্পতার অন্যতম সাধারণ কারণগুলি হল লৌহ পদার্থের-অভাব এবং ফলিক অ্যাসিডের অভাব। বর্ধিত প্লাজমা ভলিউমের (খড়-রঙের আঠাল তরল যা রক্তের কোষ ধারণ করে) অনুপাতে রক্ত কনিকার উত্পাদনের (রক্তের একটি সেলুলার উপাদান - আরবিসি) অতিরিক্ত প্রয়োজনের কারণে গর্ভাবস্থা নিজেই রক্তাল্পতার একটি কারণ।
কিভাবে এই রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসা করা হয়?
মহিলাদের উপসর্গ অনুযায়ী সাধারণত রোগের নির্ণয় করা হয়, কিন্তু গর্ভাবস্থার, যেকোন স্তরে, হিমোগ্লোবিনের স্তর (এইচ বি) জানার জন্য সম্পূর্ণ রক্তকণিকার গণনা (সি বি সি) সংক্রান্ত পরীক্ষা আবশ্যিক। এই এইচ বি স্তর যদি 10-11 জি/ডি এল এর কম হয়, তাহলেই রক্তাল্পতা বা অ্যানিমিয়া বলে গণ্য করা হয়। এটাকে একটা সামান্য অবস্থা বলে ধরা হয়। যদি কোন মহিলার রক্তাল্পতা ধরা পড়ে, তবে এর সাথেই মিন করপাস্কুলার ভ্লিউম (এম সি ভি) পরীক্ষারও প্রয়োজন হয়। এই পরীক্ষাতে সিরাম ফেরিটিনের (লৌহ) পরিমাপ, হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফোরেসিস অর্থাৎ হিমোগ্লোবিনোপ্যাথিসের (হিমোগ্লোবিন অণুর একটি উত্তরাধিকার সুত্রে পাওয়া ব্যাধি) পরিমাপ, সিরাম ফলিক অ্যাসিড, এবং ভিটামিন বি12 এর স্তর পরীক্ষা করা হয়।
চিকিৎসা বলতে সাধারণত আভ্যন্তরীণ কারণগুলির চিকিৎসাকেই বোঝায়। এই অবস্থায় চিকিৎসা ও সারিয়ে তোলা বা রোগটিকে রিভার্স করার জন্য লৌহ বা আয়রন ও ভিটামিন সাপ্লিমেন্টস্ বা পরিপূরক ওষুধগুলি দেওয়া হয়। লৌহ সমৃদ্ধ ও ফোলেট সমৃদ্ধ খাবারও এর সাথে খেতে বলা হয় যাতে হিমোগ্লোবিন স্তরের দ্রুত উন্নতি ঘটে। এছাড়াও, বিরল ও গুরুতর অবস্থার ক্ষেত্রে ডাক্তার ব্লাড ট্রান্সফিউশন বা রক্ত পরিসঞ্চালনের কথাও বলতে পারেন। লৌহসমৃদ্ধ খাবারের উদাহরণগুলি হল- মাংস, ডিম, সবুজ পাতাযুক্ত সব্জী, বাদাম, বীজ জাতীয় খাবার, ডাল জাতীয় খাবার, বীনস্, টোফু প্রভৃতি। ভিটামিন সি এর উপস্থিতি লৌহ জাতীয় খাবারের শোষণক্রিয়াকে বৃদ্ধি করে। ভিটামিন সি সমৃদ্ধ খাবারের মধ্যে লেবু জাতীয় ফলগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে সেগুলি হল কমলালেবু, টমেটো, স্ট্রবেরী, কিউই, আর বেলপেপার।